মাত্র দুই মাস আগে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে টেলিভিশন টকশোগুলোতে সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ সাহেদের সরব উপস্থিতি ছিল যেখানে তিনি রাজনীতি, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বিষয় এবং এমনকি দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কিত সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতেন। এভাবেই তিনি তার প্রতারণামূলক কাজগুলো করার জন্য নাম এবং খ্যাতির প্রভাব অর্জন করেন।
তার অপকর্ম এবং ভুয়া করোনা পরীক্ষার প্রতারণামূলক কাজগুলো প্রকাশ্যে আসায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা মিডিয়াটিকে সেন্সর করে চলেছেন এবং মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের এমন অপব্যবহারের জন্য কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাহেদের ঘটনা মিডিয়ার লোকদের জন্য এক কড়া বার্তা। কীভাবে একজন ধূর্ত লোক তাদের বোকা বানিয়েছেন ও কীভাবে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করা যায় তার উপায় তাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং কোনো খারাপ উপাদানই মিডিয়াকে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না তা তাদের নিশ্চিত করতে হবে।
সেই সাথে বিশেষজ্ঞরা কাউকে গণমাধ্যমে ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া বা হাইলাইট করার আগে, বিশেষ করে টিভি টকশোগুলোতে আমন্ত্রণ জানানোর আগে লোকজনের ব্যাকগ্রাউন্ডের বিষয়ে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সাহেদের মিডিয়া সংযোগ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি টেলিভিশনের বার্তা বিভাগের প্রধান জানান, সাহেদকে প্রথমে একটি রাজনৈতিক দলের বিশ্লেষক হিসেবে ২০১০ সালে শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেলের একটি টকশোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে তিনি অনেক সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছেন এবং এরপর অন্যান্য টেলিভিশন টকশোতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন।
সাহেদ আরও পরিচিত এবং জনপ্রিয় টিভি টকশো আলোচক হয়ে উঠলেন যখন তিনি ২০১৭ সাল থেকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সাব কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় ব্যবহার শুরু করেন। ২০১৮ সাল থেকে প্রায় সব টিভি টকশোতে তার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়, এমনকি তিনি দৈনিক দুই-তিনটি টকশোতেও অংশ নিয়েছেন।
তিনি টকশোতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তার সম্পর্ক ব্যবহার করে টিভি কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেন।
আরও অভিযোগ রয়েছে যে একদল সাংবাদিক তাকে টিভি টকশোগুলোতে নিয়মিত অতিথি হওয়ার সুযোগ দিতেন, যেখানে তিনি কতটা শক্তিশালী তা দেখানোর জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ ও ছবি তুলে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করতেন।
সাহেদ শুধু টকশোগুলোতে নিয়মিত অংশ নিতেন না, ২০১৬ সালে তিনি উপস্থাপক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। এমনকি তিনি নামমাত্র পত্রিকার সম্পাদক ও মালিকও হয়েছেন।
সাহেদ ‘দৈনিক নতুন কাগজ’ নামে একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন অপকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচাতে পত্রিকাটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সম্পাদক এবং প্রকাশকও হন।
অবশেষে কিন্তু মিডিয়াই রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার কেলেঙ্কারি নিয়ে সংবাদ প্রচার করে। যার ফলে আইন প্রয়োগকারীরা রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় এবং ১৫ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করে।
মিডিয়ার জন্য শিক্ষা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, টকশোতে অংশগ্রহণকারী, আয়োজক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে মিডিয়ায় সাহেদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, ‘যখন রিজেন্ট হাসপাতাল করোনার চিকিৎসা শুরু করেছিল তখন কিছু মিডিয়া তাকে মানবতাবাদী এবং সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিত করেছিল। তাই গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে জনগণের মনে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। মিডিয়া পুরোপুরি অন্ধকারে ছিল কি না বা মিডিয়া তার অপকর্ম সম্পর্কে জেনে কোনো প্রতারণার প্রচার করেছিল কি না তা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।’
ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক এ অধ্যাপক বলেন, কোনো তথ্য ছড়িয়ে দেয়া এবং কাউকে তুলে ধরার আগে মিডিয়ার মূল ভূমিকা হলো পরীক্ষা করা এবং ক্রস-চেক করা। ‘যদি সাংবাদিকরা তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করত তবে সাহেদ মিডিয়ায় গ্রহণযোগ্যতা পেতেন না এবং তার অপকর্মগুলো অনেক আগেই প্রকাশিত হতো। এটি গণমাধ্যমের ব্যর্থতা যে তারা সাহেদকে ভুলভাবে প্রচার করেছিল।’
তিনি বলেন, সাহেদের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে মিডিয়া আউটলেটগুলোকে তাদের ভূমিকা, নীতি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ‘মিডিয়াতে এখন তাদের অনুষ্ঠাগুলোতে এবং টকশোতে হাইলাইট করার জন্য কাকে আমন্ত্রণ জানাবে সে সম্পর্কে পরীক্ষা করা উচিত। বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষক হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের কাজকর্মের জন্যও মিডিয়াকে তীব্র নজর রাখা উচিত যাতে সাহেদের মতো ব্যক্তিরা মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো কাজে লাগাতে না পারে।’
দৈনিক অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সাহেদের মতো একজন প্রতারকের উত্থানের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে জনগণের প্রশ্নের উত্তর পেতে মিডিয়া আউটলেট এবং সাংবাদিকদের আত্ম-অনুসন্ধান করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অসাবধনতা, দুর্বলতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে সাহেদ তার ব্যক্তিগত লাভের জন্য মিডিয়া ব্যবহার করতে পেরেছিল। সুতরাং আমাদের আরও যত্নবান ও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত যাতে সাহেদের মতো কেউ আগামী দিনে মিডিয়াকে বোকা বানাতে না পারে।’
একুশে টেলিভিশনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাহেদের ঘটনাটি বিভিন্ন প্রোগ্রাম এবং মন্তব্যের জন্য অতিথি এবং বিশেষজ্ঞ বাছাই নিয়ে মিডিয়ার জন্য একটি বড় শিক্ষা।
‘টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে এখন তাদের অনুষ্ঠানগুলোর জন্য অতিথি নির্বাচন করার সময় সাবধান হওয়া উচিত। কাউকে বিশেষজ্ঞ বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় করানোর আগে মিডিয়াকে তার ব্যাকগ্রাউন্ড এবং কার্যক্রমগুলো পরীক্ষা করা উচিত,’ যোগ করেন বুলবুল।
সাহেদের সাথে তার ছবি সম্পর্কে বুলবুল বলেন, তিনি তার অপকর্ম সম্পর্কে অবগত নন এবং যেহেতু তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসেবে বহু রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে যোগ দিতেন তাই তিনি তাকে ছবি তোলার অনুমতি দিয়েছেন।
বুলবুল বলেন, ‘সাহেদ কেবল গণমাধ্যমের লোকদেরই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকেও বোকা বানিয়েছেন কারণ তার উপস্থিতি সর্বত্র ছিল। সুতরাং, তার উত্থানের জন্য মিডিয়া পুরোপুরি দায়ী নয়।’